আরতি মুখোপাধ্যায়

১.
এক বৈশাখে দেখা হলো দু’জনায় --- জষ্ঠিতে হলো পরিচয় ;
আসছে আষাঢ় মাস, মন তাই ভাবছে কী হয়, কী হয় !
কী জানি কী হয় !
তখনই তো হলো দেখা যেই না নয়ন কিছু চেয়েছে,
জানাজানি হয়ে গেছে অধর যখনই কথা পেয়েছে---
জানি না তো কি যে হবে এর পরে কিছু পেলে এ হৃদয়
প্রথমে চমক ছিল, তারপরে ভালোলাগা এসেছে,
ডুবে গেছে সেই মন, যে মন খুশির স্রোতে ভেসেছে--
জানি না তো কী যে হবে সব কিছু হয়ে গেলে তন্ময়।


২.
মনে রেখো মোরে যদি আমি চলে যাই.
আমার হৃদয়ে যে-ছবি এঁকেছি
সে যে শুধু তোমারি তোমারি তোমারি !
প্রথম বরষা যেদিন জীবনে এলো
খেয়ালী ময়ূর খুশীর মাধূরী পেলো
মরমী বীণায় যে গান রেখেছি
সে যে শুধু তোমারি তোমারি তোমারি !
যে-কথা বলিনি বলিতে পারিনি যারে
তোমারি সে-কথা সাজায়ে রেখেছি
প্রাণের অলংকারে ;
প্রথম ফাল্গুনে জ্যোছনা নিবিড় রাতে
ফুল-রাখী আমি বেঁধেছি তোমারি হাতে
যে আলোয় আমি আমারে দেখেছি
সে যে শুধু তোমারি তোমারি তোমারি।


৩.
আঁকা বাঁকা পথে যদি মন হয়ে যায় নদী
তীর ছুঁয়ে বসে থাকি না
আমাকে ধরে রাখি না।।
খোলা আকাশের নীচে ছুটে চলি সারা বেলা
ছায়া দিয়ে পথ ঢাকি না
আমাকে ধরে রাখি না।।
ওই যে যাযাবর পাখি ডানা মেলে
পালকে কিছু লিখে দিয়ে গেল ফেলে
ওখানে ভেসে গেছি উজানে মিশে গেছি
কাউকে পিছু ডাকি না।।
এই যে দূর থেকে আরও দূরে ভেসে
নিজেকে নিয়ে চলি নামহারা দেশে
পাথেয় হলো শুধু পথেরই ভালোবাসা
কাউকে পিছু ডাকি না।।


৪.
হারিয়ে যেতে যেতে অজানা সংকেতে
ছাড়িয়ে গেছি সেই পথ
কখনো মেঘে ঢাকা, কখনো আলো মাখা
ভুলেছি ভবিষ্যত।।
হৃদয়ে কার যেন সন্ধানে
খুঁজেছে দুটি চোখে সবখানে।
সে চোখে যত আলো যত আশা ভালোবাসা
খুলবে এ বন্ধ মনের জগত।।
অন্ধকারে তাকে যায় চেনা
শূণ্য হাতে সে আসবে না।
ভাবি এ চলা কবে শেষ হবে
আলোয় ফেরা সে উৎসবে।
জীবনে যত কিছু দূর থেকে দেখে দেখে
পাইনি তো মূল্য দেবার মূলরত।।


৫.
তোমায় দেখে ছবি এঁকে
মনের একান্তে দিলাম রেখে।
হৃদয় বলে আমায় ডেকে
ভালোবাসা দিয়ে রেখো ঢেকে।।
আসুক নেমে বরষা ঘোর
তুমি রয়েছ গভীর এ মন।
দেখা দিও শুধু আড়াল থেকে।।
আমায় আমি এমন করে
বুঝিনি এ জীবন ভরে।
যদি কখন চোখের তারায়
মনের ছবিতে নেমে দাঁড়ায়।
তারই আলোয় চিনে নেবো সে কে।।


৬.
মন্দির মস্‌জিদ গীর্জায় আমার প্রার্থনা
আমি বলি জগতের মঙ্গল হোক
শুধু মঙ্গল হোক।
যে আছে যেখানে গৃহে আবাসে
চোখের বাহিরে পথে প্রবাসে
শান্তিতে সবাই থাকুক
কেউ যেন পায় নাকো শোক।
কি হবে জীবনে বৃথা কলহে
সময়তো যাবে কাল প্রবাহে
পর করে দেখোনা সবারে
ভুলে রাখ আপনার দুখ।


৭.
না বলে এসেছি, তা বলে ভেবো না, না বলে বিদায় নেবো
চলে যাই যদি, যেন হই নদী, সাগরে হারিয়ে যাব।।
অন্ধ আবেগে বলতে চেয়েছি হয় নি যে কথা বলা,
কৃষ্ণচৃড়াতে পথ ঢেকেছিল হয় নি সে পথে চলা
এই নির্জনে নয়নে নয়নে প্রেমের কবিতা ভাবো ।।
তোমাকে দেখার লুকানো আশায় অঙ্গে গোধূলি ভরা,
শুধু বারে বারে ফিরে ফিরে চাওয়া হৃদয় নৃত্য করা।
লজ্জা জড়ানো, গন্ধ ছড়িয়ে, জাগতে পারে নি কুঁড়ি,
লক্ষ মরণে, মরতে চেয়েছি, সয় নি সে লুকোচুরি–
আজ এইক্ষণে বুঝিনি গোপনে নিজেকে আবার পাব।।


৮.
লজ্জা! মরি মরি একী লজ্জা!
ওগো তুমি না এলে যে কাঁটাতে ভরে গো
আমার এ ফুলের শয্যা।।
(মরে যাই একি লজ্জা!)
মায়াকাজলে নয়ন সাজায়ে চাঁদিনী রাতে দেখি আঁধার,
মনেরই ছায়ায় কত কি যে গড়ি, মনে মনেই আমি ভাঙি আবার
কাকে বোঝাবো, কিসে মেটাবো তোমাতে পেয়েছে মন যা।।
আমাকে দেখে সকলে বলে, মানিনী ওরে, হলো কি তোর
নীরবে আমি দেখি যে আকাশ, এ নিশি কবে হবে গো ভোর
কাকে বোঝাবো, কিসে মেটাবো তোমাতে পেয়েছে মন যা।।


৯.
জলে নেবো না আর থই পাবে না
থই থই করে নদী এখন যে বরষা,
এ সময় এ নদীর নেই কোনো ভরসা
খুব জল, ডুব জল, নেই কূল নেই তল,
জল খেলা খেলো না আর তুমি সহসা ।
দিন নেই রাত নেই বান আসছে,
থেকে থেকে কার টান আসছে,
ভাঙছে তো ভাঙছেই, পাড় ভাঙছে
ঢেউ আসে ঝাঁপিয়ে প্রাণ করে সরসা।
তরঙ্গে তরঙ্গে ওঠে ঘুর্ণি,
দুরন্ত মন হলো আশা-পূর্ণি,
জ্বলছে তো জ্বলছেই জল চুমকি
কোন্ তৃষা জ্বলে রে অন্তর হরষা।


১০.
নদীর যেমন ঝরনা আছে ঝরনারও নদী আছে,
আমার আছো তুমি, শুধু তুমি !
বাঁশির যেমন কৃষ্ণ আছে কৃষ্ণেরও বাঁশি আছে,
আমার আছ তুমি, শুধু তুমি !
যতই থাকো দূরে সরে, তোমায় দূরে ভাববো কেন---
তোমার আমার মাঝে ওগো আড়াল তুলে রাখবো কেন ?
সুখের যেমন দুঃখ আছে দুঃখের মাঝেও সুখ আছে--
আমার আছো তুমি, শুধু তুমি !
তোমার মধুর অভিসারে চিরজনম চলব আমি,
সুরে সুরে গানে গানে তোমার কথাই বলব আমি।
পথের যেমন পথিক আছে পথিকেরও পথ আছে---
আমার আছো তুমি, শুধু তুমি !


১১.
বন্য বন্য এ অরণ্য ভালো,
অন্ধকারে সূর্য সোনা আলো,
অন্যমনে জনারণ্যে বন্দী হয়ে থেকে কি হবে,
কী পাবে, নিজেকে হারাবে।
বন্ধ ঘরে ঘুরে ফিরে যাব না আর হারিয়ে,
স্বপ্ন দেখার সঙ্গী হতে দিও না হাত বাড়িয়ে।
ভয়ের সঙ্গে ভাব করেছি, ভয় দেখিয়ে ডেকো না।
অন্ধ লোভে লোকালয়ে থাকে তোমরা জড়িয়ে,
শূন্য হৃদয় নিয়ে শুধু ছিন্ন সুখে ভরিয়ে
অনেকটা পথ পার হয়েছি থমকে যাব ভেবো না।

১২.

সব দুষ্টু ছেলেরাই লক্ষ্মী
তারা বাঁধনছাড়া পক্ষী।
সব দিগ্বিজয়ী বীর
যদি সঙ্গে থাকে ভয় কি।।
যত ভালো ছেলেরাই বোকা
শুধু পড়ে লেখে কাঁদে। 
তারা চিরকালই খোকা
সব কাজে পড়ে ফাঁদে।
এই দস্যি দামোদল
দেখো শক্ত কত নয় কি।।
যত গাধা পিটিয়ে ঘোড়া
তারা চলতে গিয়ে খোড়া।
শুধু দুষ্টু সোনারাই
মিছে দেয় না কোনো ঝক্কি।।
আমি দুষ্টু ভালোবাসি
তারা নয় কো গোবর গণেশ।
তাদের মিষ্টি লাগে হাসি
আর ছন্নছাড়া বেশ।
দেশে দস্যু এলে 'পর
তারা শান্তি পথে রক্ষী।।

 

 

হারিয়ে যেতে যেতে অজানা সংকেতে
ছাড়িয়ে গেছি সেই পথ
কখনো মেঘে ঢাকা, কখনো আলো মাখা
ভুলেছি ভবিষ্যত।।
হৃদয়ে কার যেন সন্ধানে
খুঁজেছে দুটি চোখে সবখানে
সে চোখে যত আলো যত আশা ভালোবাসা
খুলবে এ বন্ধ মনের জগত।।
অন্ধকারে তাকে যায় চেনা
শূণ্য হাতে সে আসবে না।
ভাবি এ চলা কবে শেষ হবে
আলোয় ফেরা সে উৎসবে
জীবনে যত কিছু দূর থেকে দেখে দেখে
পাইনি তো মূল্য দেবার মূলরত।।